০৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাবরি ধ্বংস… কংগ্রেসও কম নয়

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার
  • / 50

বাবরির গম্বুজ ধ্বংস দেখে বিজেপি নেতা মুরলী মনোহর যোশীর পিঠে উঠে আনন্দ সাধ্বী উমা ভারতীর।

আহমদ হাসান ইমরান:  বাবরি মসজিদ। কী করে প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন একটি মসজিদকে ধ্বংস করা হল, সে কাহিনি এখন সারাবিশ্ব জানে। আসলে সংখ্যাগুরু হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও তার বোধহয় অবৈধ বিশেষ অধিকার থাকে! বাবরি মসজিদ অন্তত এই কথাটি একবার নয়, বরং বেশ কয়েকবার প্রমাণ করেছে। তবে বাবরি মসজিদ নিয়ে মামলাটি শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৮৫৫ সালে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এই বিবাদে হস্তক্ষেপ করেন এবং তিনি শান্তির স্বার্থে খানিকটা হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

ব্রিটিশরা কয়েক বছর পর বাবরি মসজিদকে ঘিরে একটি প্রাচীর তুলে দেয়। আর বাবরি মসজিদ প্রাচীরের বাইরে হিন্দুরা পুজোপাঠ করতে থাকে। ততদিনে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, মসজিদটি নাকি লর্ড রামের জন্মস্থান। এর আগে কিন্তু রামায়ন রচয়িতা তুলসী দাস থেকে শুরু করে কেউই দাবি করেননি যে, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ হচ্ছে রামের জন্মস্থান।

ভারত স্বাধীন হয়। দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল কংগ্রেস। ১৯৪৯ সালে ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে কে বা কারা বাবরি মসজিদের ভিতর রাম ও সীতার মূর্তি স্থাপন করে। ফজরের সময় নামায পড়তে এসে মুসল্লিরা দেখেন, সেখানে মসজিদের মধ্যে রাম ও সীতার মূর্তি রয়েছে। এ বিষয়ে থানায় প্রথম ডায়েরিটি করেছিলেন একজন হিন্দু কনস্টেবল। তাঁর বয়ানে তিনি বলেন, কীভাবে সেখানে রাম ও সীতার মূর্তি এনে রেছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বাবরি মসজিদের ভিতর থেকে এই রাম ও সীতার মূর্তি অপসারণ করেনি।

সেইসময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন একজন হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতা। তিনি কিছুতেই বাবরি মসজিদের ভিতর রেখে দেওয়া মূর্তি পুলিশ দিয়ে সরাতে রাজি হননি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নেহরুও এ বিষয়ে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি টলেননি। এরপর মামলা আদালতে গড়ায়। আদালত স্ট্যাটাস কো বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। ফলে মসজিদের ভিতর মূর্তি রয়ে যায় এবং সেখানে ১৯৪৯-এর ডিসেম্বর থেকে নামায পাঠ বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই শুধু যে বিজেপি, আরএসএস বা গেরুয়া বাহিনী বাবরি মসজিদের জবরদখলকারীর মধ্যে রয়েছে, তা নয়। সেক্যুলার কংগ্রেসের ভূমিকাও গেরুয়াপন্থীর থেকে কোনও অংশে কম নয়।

তারপর নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি হিন্দু ভোটের পক্ষে হেলে পড়েন। তাঁর সঙ্গে কট্টরপন্থী হিন্দুদের এক সমঝোতা হয়। আর তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে বাবরি মসজিদে যে তালা ঝুলছিল তা হিন্দুদের পুজোপাঠের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৮৬ সালে। অবশ্য মাঝখানে রয়েছে এক স্থানীয় কোর্টের আদেশ। তখন থেকে বাবরি মসজিদের ভিতর রামলালা ও তাঁর স্ত্রী সীতার পুজো শুরু হয়ে যায়।

এতসব কথা এ জন্য লেখা হল যে, শুধু বিজেপি, আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নয়, বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পিছনে কংগ্রেসের ভূমিকাও যে কম নয় তা বলার জন্য।

এরপর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও যে ভূমিকা পালন করেন তা এখন ইতিহাসের অংশ। অনেক সাংবাদিক ও প্রশাসক লিখেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আধা-সামরিক বাহিনী বাবরি মসজিদ কথিত করসেবকদের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু নরসীমা রাও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য কোনও উদ্যোগ না নিয়ে নীরবে বসে থাকেন।

যদিও সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাবরি মসজিদের কাঠামোর কোনও ক্ষতি করা হবে না। তিনি ইচ্ছা করলে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংকে বরখাশত করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারতেন। কিন্তু আসলে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাই ছিল যে, ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে। আর এতে শামিল ছিল বিজেপি ও কংগ্রেসের অনেকেই। এমনকী যে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে খানিকটা সেক্যুলার বলে অনেকে গণ্য করেন, তিনিও কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক আগে ৫ ডিসেম্বর ফৈজাবাদে এসে কথিত করসেবকদের কাছে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ‘আগামীকাল আপনারা অযোধ্যায় যাচ্ছে। সেখানে জমিকে সমতল করতে হবে।’

এরপর আদবানিজি থেকে শুরু করে অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছিল, চার্জশিট জমা হয়েছিল। কিন্তু পরে সবাইকেই সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। কাজেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসে শুধু বিজেপিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদীরাও তাতে সমান অংশীদার।

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

বাবরি ধ্বংস… কংগ্রেসও কম নয়

আপডেট : ৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার

আহমদ হাসান ইমরান:  বাবরি মসজিদ। কী করে প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন একটি মসজিদকে ধ্বংস করা হল, সে কাহিনি এখন সারাবিশ্ব জানে। আসলে সংখ্যাগুরু হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও তার বোধহয় অবৈধ বিশেষ অধিকার থাকে! বাবরি মসজিদ অন্তত এই কথাটি একবার নয়, বরং বেশ কয়েকবার প্রমাণ করেছে। তবে বাবরি মসজিদ নিয়ে মামলাটি শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৮৫৫ সালে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এই বিবাদে হস্তক্ষেপ করেন এবং তিনি শান্তির স্বার্থে খানিকটা হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

ব্রিটিশরা কয়েক বছর পর বাবরি মসজিদকে ঘিরে একটি প্রাচীর তুলে দেয়। আর বাবরি মসজিদ প্রাচীরের বাইরে হিন্দুরা পুজোপাঠ করতে থাকে। ততদিনে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, মসজিদটি নাকি লর্ড রামের জন্মস্থান। এর আগে কিন্তু রামায়ন রচয়িতা তুলসী দাস থেকে শুরু করে কেউই দাবি করেননি যে, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ হচ্ছে রামের জন্মস্থান।

ভারত স্বাধীন হয়। দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল কংগ্রেস। ১৯৪৯ সালে ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে কে বা কারা বাবরি মসজিদের ভিতর রাম ও সীতার মূর্তি স্থাপন করে। ফজরের সময় নামায পড়তে এসে মুসল্লিরা দেখেন, সেখানে মসজিদের মধ্যে রাম ও সীতার মূর্তি রয়েছে। এ বিষয়ে থানায় প্রথম ডায়েরিটি করেছিলেন একজন হিন্দু কনস্টেবল। তাঁর বয়ানে তিনি বলেন, কীভাবে সেখানে রাম ও সীতার মূর্তি এনে রেছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বাবরি মসজিদের ভিতর থেকে এই রাম ও সীতার মূর্তি অপসারণ করেনি।

সেইসময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন একজন হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেস নেতা। তিনি কিছুতেই বাবরি মসজিদের ভিতর রেখে দেওয়া মূর্তি পুলিশ দিয়ে সরাতে রাজি হননি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নেহরুও এ বিষয়ে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি টলেননি। এরপর মামলা আদালতে গড়ায়। আদালত স্ট্যাটাস কো বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। ফলে মসজিদের ভিতর মূর্তি রয়ে যায় এবং সেখানে ১৯৪৯-এর ডিসেম্বর থেকে নামায পাঠ বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই শুধু যে বিজেপি, আরএসএস বা গেরুয়া বাহিনী বাবরি মসজিদের জবরদখলকারীর মধ্যে রয়েছে, তা নয়। সেক্যুলার কংগ্রেসের ভূমিকাও গেরুয়াপন্থীর থেকে কোনও অংশে কম নয়।

তারপর নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি হিন্দু ভোটের পক্ষে হেলে পড়েন। তাঁর সঙ্গে কট্টরপন্থী হিন্দুদের এক সমঝোতা হয়। আর তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে বাবরি মসজিদে যে তালা ঝুলছিল তা হিন্দুদের পুজোপাঠের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৮৬ সালে। অবশ্য মাঝখানে রয়েছে এক স্থানীয় কোর্টের আদেশ। তখন থেকে বাবরি মসজিদের ভিতর রামলালা ও তাঁর স্ত্রী সীতার পুজো শুরু হয়ে যায়।

এতসব কথা এ জন্য লেখা হল যে, শুধু বিজেপি, আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নয়, বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পিছনে কংগ্রেসের ভূমিকাও যে কম নয় তা বলার জন্য।

এরপর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও যে ভূমিকা পালন করেন তা এখন ইতিহাসের অংশ। অনেক সাংবাদিক ও প্রশাসক লিখেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আধা-সামরিক বাহিনী বাবরি মসজিদ কথিত করসেবকদের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু নরসীমা রাও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য কোনও উদ্যোগ না নিয়ে নীরবে বসে থাকেন।

যদিও সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাবরি মসজিদের কাঠামোর কোনও ক্ষতি করা হবে না। তিনি ইচ্ছা করলে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংকে বরখাশত করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারতেন। কিন্তু আসলে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাই ছিল যে, ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙা হবে। আর এতে শামিল ছিল বিজেপি ও কংগ্রেসের অনেকেই। এমনকী যে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে খানিকটা সেক্যুলার বলে অনেকে গণ্য করেন, তিনিও কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঠিক আগে ৫ ডিসেম্বর ফৈজাবাদে এসে কথিত করসেবকদের কাছে বক্তব্য দিয়েছিলেন, ‘আগামীকাল আপনারা অযোধ্যায় যাচ্ছে। সেখানে জমিকে সমতল করতে হবে।’

এরপর আদবানিজি থেকে শুরু করে অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছিল, চার্জশিট জমা হয়েছিল। কিন্তু পরে সবাইকেই সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়। কাজেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসে শুধু বিজেপিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদীরাও তাতে সমান অংশীদার।