০৪ মে ২০২৫, রবিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পর্যটকদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন কাশ্মীরিরা

কিবরিয়া আনসারি
  • আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার
  • / 91

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে পাহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলা। মঙ্গলবার সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে উপত্যকা। ওই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬জন নিরীহ পর্যটক।আহত হয়েছেন একাধিক পর্যটক। আতঙ্কে বিপুল সংখ্যক পর্যটক উপত্যকা ছাড়তে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ছে শ্রীনগর বিমানবন্দরে। এদিকে বিপদের সময়ে মাতারিক্ত ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিমানের। বাড়ি ফেরার জন্য বিমানের টিকিট কাটতে গিয়েই আঁতকে উঠছেন হাজার হাজার পর্যটক। কেউ কেউ বলছেন, কারো সর্বনাশ তো কারো পোষ মাস।

ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা পর কাশ্মীর জুড়ে দেখা গিয়েছে এক অন্য ছবি। কঠিন এই পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে পর্যটকদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ কাশ্মীরিরা। জীবনের পরোয়া না করেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ঘোড়া সহিস সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। কাশ্মীর ঘুরতে আসা পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে এক জঙ্গির হাত থেকে বন্দুক কাড়তে গিয়ে নিহত হন সাতচল্লিশ বছর বয়সী আদিল। উপত্যকা জুড়ে এভাবেই পর্যটকদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন কাশ্মীরিরা। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল এক ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, আহত এক পর্যটককে নিজের কাঁধে করে উদ্ধার করে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন এক কাশ্মীরি মুসলিম যুবক। ওই পর্যটককে কাঁধে করেই কয়েক কিমি পাহাড়ি এলাকা পেরিয়ে তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান কাশ্মীরি শাল বিক্রেতা সাজাদ আহমেদ ভাট। সময়মত হাসপাতালে পৌঁছনোর ফলে প্রাণে বেঁচে যান আহত পর্যটক। সাজাদের এই সাহসী কাজের প্রশংসায় ভরে গিয়েছে সামাজিক মাধ্যম। এক নেটিজেন লিখেছে, ‘মানবসেবাই আসল ধর্ম, আর এটিই আসল মানবতা।’

সাজাদ আহমেদ এক সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছে, “আমি বাড়িতে বসে ছিলাম। সেই সময় খবর পেলাম পাহেলগাঁওয়ে বিপদে পড়েছেন পর্যটকরা। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। অনেকেই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ছিলেন। তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যায়। তাদের জল-খাবারের ব্যবস্থা করি। যারা হাঁটতে পারছিলেন না, তাদের কাঁধে করে নিয়ে যায়। একজন আহত হয়েছিলেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।” শাল বিক্রেতার কথায়, “ধর্মের আগে মানবতা। বিপদগ্রস্থ পর্যটকদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। কারণ তাদের ওপরেই আমাদের জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। যখন আমি ঘটনাস্থলে যায় তখন পর্যটকদের কান্না দেখে আমি নিজেই ভেঙে পড়ি। তাদের আর্তনাদ দেখে আমার চোখে জল চলে আসে।”

জানা গিয়েছে, হামলার ঘটনার পর থেকে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত কাশ্মীরিরা। আটকে পড়া বহু পর্যটকদের জন্য নিজেদের দুয়ার খুলে দিয়েছে তারা। অনেক স্থানীয় বাসিন্দা তাদের বাড়িতে পর্যটকদের আশ্রয় দিয়েছে। অনেক হোটেলে ফ্রিতে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমনকি পর্যটকদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়াও নিচ্ছেন না বহু গাড়ি চালক। পর্যটকদের বিমান বন্দরে পৌঁছে দিতে ফ্রি পরিষেবা চালু করেছে কাশ্মীরের লালচক অটো ইউনিয়ন। মুসলিম এক অটো চালক বলেন, পর্যটকরা পরিবার নিয়ে কাশ্মীর ঘুরতে এসেছিল। কেনো নিরীহ পর্যটকদের হত্যা করা হল! কি দোষ ছিল তাদের! সন্ত্রাসবাদীরা শুধু পর্যটকদের হত্যা করেনি। তারা গোটা কাশ্মীরিদের হত্যা করেছে। যারা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে তারা কোনদিনই মানুষ হতে পারে না। তারা মানবতার শত্রু।” তিনি আরও বলেন, “৪০ বছর আমি অটো চালাচ্ছি। পর্যটকরা আমাদের অন্নদাতা। এই বিপদের সময় যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। যে কারণে ইউনিয়নের সমস্ত অটো চালকরা ফ্রিতে পরিষেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পর্যটকরা যেখানে যেতে চাইবেন, তাদের ফ্রিতে সেখানে পৌঁছে দেওয়া হবে। পর্যটকদের জন্য আমরা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।”

কাশ্মীরে আটকে পড়া এক মহারাষ্ট্রের পর্যটক জানান, “হামলার ঘটনার পর আমরা আতঙ্কিত হয়ে পরেছিলাম। কাশ্মীরিরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবার পাশে দাঁড়িয়ে তারা। কাশ্মীরিরা দ্বৈত কণ্ঠে বলেছে, নিজেদের জীবন দিয়ে দেবো, কিন্তু আপনাদের কিছু হতে দেবো না। কিন্তু গোটা দেশজুড়ে মুসলিমদের দোষারোপ করা হচ্ছে, অন্য বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। আমি নিজে একজন হিন্দু হয়ে বলছি, হিন্দুদের জন্য মুসলিমরা হুমকির নয়, একইভাবে মুসলিমদের জন্য হিন্দুরা হুমকির নয়। আমরা একে অপরের পরিপূরক। এটাই দেশের ঐতিহ্য।”

এদিকে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে সাধারণ কাশ্মীরি নাগরিকরা। উপত্যকা জুড়ে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা নেমে প্রতিবাদ করছে তারা। হামলাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র। সর্বধর্মের মানুষ একযোগে প্রতিবাদ করছে। এক প্রতিবাদীর বক্তব্য, এই হামলা শুধু কাশ্মীর বা পর্যটকদের ওপর করা হয়নি। বরং সমস্ত ভারতীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমরা চাই, হামলায় জড়িতদের যাতে কোনও রেয়াত না করা হয়।

প্রতিবেদক

কিবরিয়া আনসারি

Kibria obtained a master's degree in journalism from Aliah University. He has been in journalism since 2018, gaining work experience in multiple organizations. Focused and sincere about his work, Kibria is currently employed at the desk of Purber Kalom.

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

পর্যটকদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন কাশ্মীরিরা

আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার

পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে পাহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসী হামলা। মঙ্গলবার সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে উপত্যকা। ওই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬জন নিরীহ পর্যটক।আহত হয়েছেন একাধিক পর্যটক। আতঙ্কে বিপুল সংখ্যক পর্যটক উপত্যকা ছাড়তে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ছে শ্রীনগর বিমানবন্দরে। এদিকে বিপদের সময়ে মাতারিক্ত ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিমানের। বাড়ি ফেরার জন্য বিমানের টিকিট কাটতে গিয়েই আঁতকে উঠছেন হাজার হাজার পর্যটক। কেউ কেউ বলছেন, কারো সর্বনাশ তো কারো পোষ মাস।

ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা পর কাশ্মীর জুড়ে দেখা গিয়েছে এক অন্য ছবি। কঠিন এই পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে পর্যটকদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ কাশ্মীরিরা। জীবনের পরোয়া না করেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ঘোড়া সহিস সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। কাশ্মীর ঘুরতে আসা পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে এক জঙ্গির হাত থেকে বন্দুক কাড়তে গিয়ে নিহত হন সাতচল্লিশ বছর বয়সী আদিল। উপত্যকা জুড়ে এভাবেই পর্যটকদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন কাশ্মীরিরা। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল এক ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, আহত এক পর্যটককে নিজের কাঁধে করে উদ্ধার করে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন এক কাশ্মীরি মুসলিম যুবক। ওই পর্যটককে কাঁধে করেই কয়েক কিমি পাহাড়ি এলাকা পেরিয়ে তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান কাশ্মীরি শাল বিক্রেতা সাজাদ আহমেদ ভাট। সময়মত হাসপাতালে পৌঁছনোর ফলে প্রাণে বেঁচে যান আহত পর্যটক। সাজাদের এই সাহসী কাজের প্রশংসায় ভরে গিয়েছে সামাজিক মাধ্যম। এক নেটিজেন লিখেছে, ‘মানবসেবাই আসল ধর্ম, আর এটিই আসল মানবতা।’

সাজাদ আহমেদ এক সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছে, “আমি বাড়িতে বসে ছিলাম। সেই সময় খবর পেলাম পাহেলগাঁওয়ে বিপদে পড়েছেন পর্যটকরা। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। অনেকেই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ছিলেন। তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যায়। তাদের জল-খাবারের ব্যবস্থা করি। যারা হাঁটতে পারছিলেন না, তাদের কাঁধে করে নিয়ে যায়। একজন আহত হয়েছিলেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।” শাল বিক্রেতার কথায়, “ধর্মের আগে মানবতা। বিপদগ্রস্থ পর্যটকদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। কারণ তাদের ওপরেই আমাদের জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। যখন আমি ঘটনাস্থলে যায় তখন পর্যটকদের কান্না দেখে আমি নিজেই ভেঙে পড়ি। তাদের আর্তনাদ দেখে আমার চোখে জল চলে আসে।”

জানা গিয়েছে, হামলার ঘটনার পর থেকে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত কাশ্মীরিরা। আটকে পড়া বহু পর্যটকদের জন্য নিজেদের দুয়ার খুলে দিয়েছে তারা। অনেক স্থানীয় বাসিন্দা তাদের বাড়িতে পর্যটকদের আশ্রয় দিয়েছে। অনেক হোটেলে ফ্রিতে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমনকি পর্যটকদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়াও নিচ্ছেন না বহু গাড়ি চালক। পর্যটকদের বিমান বন্দরে পৌঁছে দিতে ফ্রি পরিষেবা চালু করেছে কাশ্মীরের লালচক অটো ইউনিয়ন। মুসলিম এক অটো চালক বলেন, পর্যটকরা পরিবার নিয়ে কাশ্মীর ঘুরতে এসেছিল। কেনো নিরীহ পর্যটকদের হত্যা করা হল! কি দোষ ছিল তাদের! সন্ত্রাসবাদীরা শুধু পর্যটকদের হত্যা করেনি। তারা গোটা কাশ্মীরিদের হত্যা করেছে। যারা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে তারা কোনদিনই মানুষ হতে পারে না। তারা মানবতার শত্রু।” তিনি আরও বলেন, “৪০ বছর আমি অটো চালাচ্ছি। পর্যটকরা আমাদের অন্নদাতা। এই বিপদের সময় যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। যে কারণে ইউনিয়নের সমস্ত অটো চালকরা ফ্রিতে পরিষেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পর্যটকরা যেখানে যেতে চাইবেন, তাদের ফ্রিতে সেখানে পৌঁছে দেওয়া হবে। পর্যটকদের জন্য আমরা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।”

কাশ্মীরে আটকে পড়া এক মহারাষ্ট্রের পর্যটক জানান, “হামলার ঘটনার পর আমরা আতঙ্কিত হয়ে পরেছিলাম। কাশ্মীরিরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবার পাশে দাঁড়িয়ে তারা। কাশ্মীরিরা দ্বৈত কণ্ঠে বলেছে, নিজেদের জীবন দিয়ে দেবো, কিন্তু আপনাদের কিছু হতে দেবো না। কিন্তু গোটা দেশজুড়ে মুসলিমদের দোষারোপ করা হচ্ছে, অন্য বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। আমি নিজে একজন হিন্দু হয়ে বলছি, হিন্দুদের জন্য মুসলিমরা হুমকির নয়, একইভাবে মুসলিমদের জন্য হিন্দুরা হুমকির নয়। আমরা একে অপরের পরিপূরক। এটাই দেশের ঐতিহ্য।”

এদিকে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে সাধারণ কাশ্মীরি নাগরিকরা। উপত্যকা জুড়ে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা নেমে প্রতিবাদ করছে তারা। হামলাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র। সর্বধর্মের মানুষ একযোগে প্রতিবাদ করছে। এক প্রতিবাদীর বক্তব্য, এই হামলা শুধু কাশ্মীর বা পর্যটকদের ওপর করা হয়নি। বরং সমস্ত ভারতীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমরা চাই, হামলায় জড়িতদের যাতে কোনও রেয়াত না করা হয়।