১৭ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

Laylatul Qadr : মহিমান্বিত রজনী

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৫, শনিবার
  • / 97

Laylatul Qadr : মহিমান্বিত রজনী

 

আবুল হাসান: পরম করুণাময় দয়াবান আল্লাহর’ নামে। ‘আমি এই (কুরআন) ক্বদরের রাত্রে অবতীর্ণ করেছি। তুমি কি জান, সেই মহিমান্বিত রাত কি? ক্বদরের রাত হাজার মাসের থেকেও উত্তম। ফেরেশতারা এবং রূহ (হযরত জিবরাঈল আ.) তাদের প্রভুর অনুমতি নিয়ে এই রাত্রে প্রত্যেকটি নির্দেশ নিয়ে অবতীর্ণ হয়, ঊষার উদয়কাল পর্যন্ত এই রাত্রি পূর্ণ শান্তিময়।’ (সূরা আল ক্বদর)

রমযান মাসকে মহিমান্বিত করেছে মূলত তিনটি বিষয় – ১. এই মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়া, ২. সিয়াম অর্থাৎ রোযা ফরয হওয়া এবং ৩. Laylatul Qadr।

সমস্ত ঐশী গ্রন্থ ও সহীফা সমূহ সবই রমযান মাসে অবতীর্ণ করেছেন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন। হযরত কাতাদাহ রা. বর্ণনা করেছেন, ‘হযরত ইব্রাহিম আ.-এর সহীফা সমূহ রমযান মাসের প্রথম তারিখে, তাওরাত কিতাব রমযানের ৬ তারিখে, যবুর ১২ তারিখে, ইঞ্জিল ১৮ তারিখে নাযিল করা হয়েছে।’

 

⚫️ রমযান: রহমতের ১০ দিন

মুসনাদে আহমাদেও এর সত্যতামূলক বর্ণনা এসেছে। উক্ত তারিখ গুলির তুলনায় আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন মহাগ্রন্থ এবং শেষ ঐশী বিধান কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার তারিখকে। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার জন্য এই রাত্রিকে আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এই একটি রাত্রিকে আল্লাহ্ মহিমান্বিত করেছেন। এই রাত্রির মর্যাদা হাজার মাসের থেকেও বেশি। সূরা বাকারার ১৮৫ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘রমাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’। সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতে উল্লে’ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি এই গ্রন্থকে এক অতি বরকতপূর্ণ রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। এই রাত হ’ল কদ্বরের রাত- লাইলাতুল ক্বদর।’

কোনও কোনও তাফসীরকার এই রাতকে ভাগ্য নির্ধারণের রাতও বলেছেন। ক্বদরের এক অর্থ ভাগ্য। কদর থেকে তকদির শব্দটি এসেছে। অর্থাৎ এই রাত্রে আল্লাহ্ তাকদীরের ফায়সালা করেন এবং তা ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। এ প্রসঙ্গে সূরা  দুখানের ৪ নং আয়াত প্রণিধানযোগ্য।

 

আল্লাহ্ বলেন, ‘এই রাত্রে সমস্ত ব্যাপারে জ্ঞানময় সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়।’ এই মহা মহিমান্বিত রাতে একটি রাতের ইবাদাত এক হাজার মাসের ইবাদতের চাইতে উত্তম। এই পবিত্র রাতে হযরত জিবরাঈল আ. ও ফেরেশতারা দলব্ধভাবে আল্লাহর হুকুমে অবতরণ করেন এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন সালাম ও শান্তি বিতরণ করতে থাকেন।

এই মহামান্বিত রাত্রি কোনটি :

হযরত আনাস বিন মালিক রা. বলেন যে, তিনি আল্লাহ্ নবী সা.-এর কাছে শুনেছেন যে, আল্লাহ্ নবী সা.-কে অবহিত করান হয় এবং তাঁর উম্মতের আমল ও সওয়াবের পরিমাণ দেখানো হয়। পূর্ববর্তী উম্মতদের বয়স অনুপাতে আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর  উম্মতদের আয়ুষ্কাল খুবই কম মনে করলেন। এই সন্ধিক্ষণে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা.-কে সান্ত্বনা দান ও চরম মর্যাদা দান হেতু লাইলাতুল কদর দান করলেন এবং কুরআনের মধ্যে আয়াত নাযিল করে বলে দিলেন যে, ‘এই এক রাতের ইবাদত হাজার মাস হতেও উত্তম।’ (মুয়াত্তা)

যে রাতের মাহাত্ম মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা কুরআন ও হাদীসের মধ্যে উল্লেখিত, যে রাতের মর্যাদায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আল ক্বদর নাযিল করেছেন, যে মহামান্বিত রাতের কয়েক ঘণ্টার ইবাদত হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম, যে রাতে হযরত জিবরাইল আ. সহ সমস্ত রহমতের ফেরেশতারা এই ধূলির ধরণীতে নেমে আসেন রহমতের অফুরন্ত ধারা বর্ষণ নিয়ে সেই মহা মহিমান্বিত রজনীকে, সেই চরম সিদ্ধি ও পরম সাফল্যের রাতকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে রমযানের শেষ দশকে।
হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন, ‘ক্বদরের রাতকে রমযানের শেষ দশ রাতের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে অন্বেষণ কর।’ (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী)

প্রিয় নবী সা.-এর কথা মতো রমযানের ২১, ২৩, ২৫ ২৭ ও ২৯ – এই পাঁচটি রাতের কোন্ রাতটি ‘Laylatul Qadr’ তা বলা কঠিন। সুনির্দিষ্টভাবে কোনও একটি রাতের উল্লে’ না পবিত্র কুরআনে রয়েছে, আর না রয়েছে আল্লাহর নবী সা.-এর কোনও হাদীসে। তাই আল্লাহ-প্রেমিক মুমিন যারা, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিষ্ঠাবান তাদেরকে এই পাঁচটি রাতে সজাগ থাকতেই হবে।

এহেন মর্যাদাপূর্ণ একটি রাত যারা হাতের কাছে পেয়েও অবহেলায় হারিয়ে ফেলে তাদের ন্যায় হতভাগ্য আর কারা হতে পারে? হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমানের সঙ্গে এবং আল্লাহ্র কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হ’ল তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারী, মুসলিম)

মুসনাদে আহমাদে হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত রা. বর্ণনা করেছেন, ‘ক্বদরের রাত রমযানের শেষ দশকের মধ্যে নিহিত। যে ব্যক্তি প্রতিদানের প্রত্যাশায় এসব রাতে ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে আল্লাহ্ তাদের আগের ও পরের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।’

লাইলাতুল ক্বদরে আমাদের করণীয় :

১. ফরয, সুন্নাত ও ওয়াজিব নামায যথা নিয়মে আদায় করার পর অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করতে হবে।

২. ইবাদত বন্দেগী, দরুদ, যিকির আযকারের মধ্য দিয়ে এই রাতগুলিতে ফজর পর্যন্ত নিজেদেরকে মশগুল রা’তে হবে। বিশেষ করে রাত্রের শেষ ভাগে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত।

৩. বুঝে বুঝে তরজমাসহ কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। কুরআনের সামষ্টিক পাঠচক্রের আয়োজন করা যেতে পারে। কুরআনের দারস দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এতে সবাই কুরআনের জ্ঞানে আলোকিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

৪. নিজেদের ভুলভ্রান্তি, অপরাধ ও অক্ষমতার কথা অনুশোচনার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। আল্লাহর দরবারে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। চোরের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। বান্দার এক ফোঁটা চোরের পানি আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের কাছে  খুবই প্রিয়।

৫. নিজেদের এইসব রাতগুলিতে জাগার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার-পরিজন ও মহল্লাবাসীদেরকেও জেগে ইবাদত করার জন্য উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে হবে।

৬. আল্লাহ্‌র রাসূল সা. লাইলাতুল ক্বদরে এই দোয়া করতে শিখিয়েছেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন্ তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী -অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাস, অতএব অমাকে ক্ষমা কর। নিজেদের জন্য দোয়া কর সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতা, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর হেদায়াত ও কল্যাণের জন্য দোয়া করাও বাঞ্ছনীয়।

৭. এইসব রাতে তো বটেই, বরং পূর্ণ রমাযান মাসের মধ্যে আমাদের প্রতিদিন প্রতি রাত্রে নিজ নিদ আমলের পর্যালোচনা ও হিসাব নিজেদের প্রতিনিয়ত করতে হবে। আল্লাহর কিতাবের অনুসারী হওয়ার জন্য নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমযান মাস, এই মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পথ-নির্দেশ, যা সত্য সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেওয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল, আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)

‘আলিফ লাম মীম’। এটি আল্লাহর কিতাব। এর মধ্যে কোনও সংশয়-সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থ হেদায়ত (পথ নির্দেশ) সেই মুক্তাকীদের জন্য যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে…।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১-২)

উপরের উল্লেখিত আয়াতগুলিতে স্পষ্ট যে, কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতস্বরূপ। কুরআনই একমাত্র জীবন বিধান। মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ কুরআনের পথ নিদের্শনার মধ্যে নিহিত। কুরআনের এই পথ নির্দেশনা তথা হেদায়াত কেবলমাত্র তারাই অর্জন করতে সক্ষমস যারা মুত্তাকী অর্থাৎ আল্লাহ্কে ভয় করে।

 

আর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে হল রমযানের সিয়াম অর্থাৎ রোযা। তা হলে একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রমযানের রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল একজন আল্লাহর বান্দাহ রোযার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে নিজেকে আল্লাহর বিধান কুরআনের অনুসারী হওয়ার যোগ্য করে গড়ে তুলবে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি করে দিন। আমীন!

 

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

Laylatul Qadr : মহিমান্বিত রজনী

আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৫, শনিবার

Laylatul Qadr : মহিমান্বিত রজনী

 

আবুল হাসান: পরম করুণাময় দয়াবান আল্লাহর’ নামে। ‘আমি এই (কুরআন) ক্বদরের রাত্রে অবতীর্ণ করেছি। তুমি কি জান, সেই মহিমান্বিত রাত কি? ক্বদরের রাত হাজার মাসের থেকেও উত্তম। ফেরেশতারা এবং রূহ (হযরত জিবরাঈল আ.) তাদের প্রভুর অনুমতি নিয়ে এই রাত্রে প্রত্যেকটি নির্দেশ নিয়ে অবতীর্ণ হয়, ঊষার উদয়কাল পর্যন্ত এই রাত্রি পূর্ণ শান্তিময়।’ (সূরা আল ক্বদর)

রমযান মাসকে মহিমান্বিত করেছে মূলত তিনটি বিষয় – ১. এই মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়া, ২. সিয়াম অর্থাৎ রোযা ফরয হওয়া এবং ৩. Laylatul Qadr।

সমস্ত ঐশী গ্রন্থ ও সহীফা সমূহ সবই রমযান মাসে অবতীর্ণ করেছেন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন। হযরত কাতাদাহ রা. বর্ণনা করেছেন, ‘হযরত ইব্রাহিম আ.-এর সহীফা সমূহ রমযান মাসের প্রথম তারিখে, তাওরাত কিতাব রমযানের ৬ তারিখে, যবুর ১২ তারিখে, ইঞ্জিল ১৮ তারিখে নাযিল করা হয়েছে।’

 

⚫️ রমযান: রহমতের ১০ দিন

মুসনাদে আহমাদেও এর সত্যতামূলক বর্ণনা এসেছে। উক্ত তারিখ গুলির তুলনায় আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন মহাগ্রন্থ এবং শেষ ঐশী বিধান কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার তারিখকে। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার জন্য এই রাত্রিকে আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এই একটি রাত্রিকে আল্লাহ্ মহিমান্বিত করেছেন। এই রাত্রির মর্যাদা হাজার মাসের থেকেও বেশি। সূরা বাকারার ১৮৫ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘রমাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’। সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতে উল্লে’ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি এই গ্রন্থকে এক অতি বরকতপূর্ণ রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। এই রাত হ’ল কদ্বরের রাত- লাইলাতুল ক্বদর।’

কোনও কোনও তাফসীরকার এই রাতকে ভাগ্য নির্ধারণের রাতও বলেছেন। ক্বদরের এক অর্থ ভাগ্য। কদর থেকে তকদির শব্দটি এসেছে। অর্থাৎ এই রাত্রে আল্লাহ্ তাকদীরের ফায়সালা করেন এবং তা ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। এ প্রসঙ্গে সূরা  দুখানের ৪ নং আয়াত প্রণিধানযোগ্য।

 

আল্লাহ্ বলেন, ‘এই রাত্রে সমস্ত ব্যাপারে জ্ঞানময় সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়।’ এই মহা মহিমান্বিত রাতে একটি রাতের ইবাদাত এক হাজার মাসের ইবাদতের চাইতে উত্তম। এই পবিত্র রাতে হযরত জিবরাঈল আ. ও ফেরেশতারা দলব্ধভাবে আল্লাহর হুকুমে অবতরণ করেন এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন সালাম ও শান্তি বিতরণ করতে থাকেন।

এই মহামান্বিত রাত্রি কোনটি :

হযরত আনাস বিন মালিক রা. বলেন যে, তিনি আল্লাহ্ নবী সা.-এর কাছে শুনেছেন যে, আল্লাহ্ নবী সা.-কে অবহিত করান হয় এবং তাঁর উম্মতের আমল ও সওয়াবের পরিমাণ দেখানো হয়। পূর্ববর্তী উম্মতদের বয়স অনুপাতে আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর  উম্মতদের আয়ুষ্কাল খুবই কম মনে করলেন। এই সন্ধিক্ষণে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা.-কে সান্ত্বনা দান ও চরম মর্যাদা দান হেতু লাইলাতুল কদর দান করলেন এবং কুরআনের মধ্যে আয়াত নাযিল করে বলে দিলেন যে, ‘এই এক রাতের ইবাদত হাজার মাস হতেও উত্তম।’ (মুয়াত্তা)

যে রাতের মাহাত্ম মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা কুরআন ও হাদীসের মধ্যে উল্লেখিত, যে রাতের মর্যাদায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আল ক্বদর নাযিল করেছেন, যে মহামান্বিত রাতের কয়েক ঘণ্টার ইবাদত হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম, যে রাতে হযরত জিবরাইল আ. সহ সমস্ত রহমতের ফেরেশতারা এই ধূলির ধরণীতে নেমে আসেন রহমতের অফুরন্ত ধারা বর্ষণ নিয়ে সেই মহা মহিমান্বিত রজনীকে, সেই চরম সিদ্ধি ও পরম সাফল্যের রাতকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে রমযানের শেষ দশকে।
হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন, ‘ক্বদরের রাতকে রমযানের শেষ দশ রাতের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে অন্বেষণ কর।’ (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযী)

প্রিয় নবী সা.-এর কথা মতো রমযানের ২১, ২৩, ২৫ ২৭ ও ২৯ – এই পাঁচটি রাতের কোন্ রাতটি ‘Laylatul Qadr’ তা বলা কঠিন। সুনির্দিষ্টভাবে কোনও একটি রাতের উল্লে’ না পবিত্র কুরআনে রয়েছে, আর না রয়েছে আল্লাহর নবী সা.-এর কোনও হাদীসে। তাই আল্লাহ-প্রেমিক মুমিন যারা, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিষ্ঠাবান তাদেরকে এই পাঁচটি রাতে সজাগ থাকতেই হবে।

এহেন মর্যাদাপূর্ণ একটি রাত যারা হাতের কাছে পেয়েও অবহেলায় হারিয়ে ফেলে তাদের ন্যায় হতভাগ্য আর কারা হতে পারে? হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে ঈমানের সঙ্গে এবং আল্লাহ্র কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হ’ল তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারী, মুসলিম)

মুসনাদে আহমাদে হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত রা. বর্ণনা করেছেন, ‘ক্বদরের রাত রমযানের শেষ দশকের মধ্যে নিহিত। যে ব্যক্তি প্রতিদানের প্রত্যাশায় এসব রাতে ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে আল্লাহ্ তাদের আগের ও পরের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন।’

লাইলাতুল ক্বদরে আমাদের করণীয় :

১. ফরয, সুন্নাত ও ওয়াজিব নামায যথা নিয়মে আদায় করার পর অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করতে হবে।

২. ইবাদত বন্দেগী, দরুদ, যিকির আযকারের মধ্য দিয়ে এই রাতগুলিতে ফজর পর্যন্ত নিজেদেরকে মশগুল রা’তে হবে। বিশেষ করে রাত্রের শেষ ভাগে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত।

৩. বুঝে বুঝে তরজমাসহ কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। কুরআনের সামষ্টিক পাঠচক্রের আয়োজন করা যেতে পারে। কুরআনের দারস দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এতে সবাই কুরআনের জ্ঞানে আলোকিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

৪. নিজেদের ভুলভ্রান্তি, অপরাধ ও অক্ষমতার কথা অনুশোচনার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। আল্লাহর দরবারে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। চোরের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। বান্দার এক ফোঁটা চোরের পানি আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের কাছে  খুবই প্রিয়।

৫. নিজেদের এইসব রাতগুলিতে জাগার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার-পরিজন ও মহল্লাবাসীদেরকেও জেগে ইবাদত করার জন্য উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে হবে।

৬. আল্লাহ্‌র রাসূল সা. লাইলাতুল ক্বদরে এই দোয়া করতে শিখিয়েছেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন্ তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী -অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাস, অতএব অমাকে ক্ষমা কর। নিজেদের জন্য দোয়া কর সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতা, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর হেদায়াত ও কল্যাণের জন্য দোয়া করাও বাঞ্ছনীয়।

৭. এইসব রাতে তো বটেই, বরং পূর্ণ রমাযান মাসের মধ্যে আমাদের প্রতিদিন প্রতি রাত্রে নিজ নিদ আমলের পর্যালোচনা ও হিসাব নিজেদের প্রতিনিয়ত করতে হবে। আল্লাহর কিতাবের অনুসারী হওয়ার জন্য নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমযান মাস, এই মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পথ-নির্দেশ, যা সত্য সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করে দেওয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল, আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)

‘আলিফ লাম মীম’। এটি আল্লাহর কিতাব। এর মধ্যে কোনও সংশয়-সন্দেহ নেই। এই গ্রন্থ হেদায়ত (পথ নির্দেশ) সেই মুক্তাকীদের জন্য যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে…।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১-২)

উপরের উল্লেখিত আয়াতগুলিতে স্পষ্ট যে, কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতস্বরূপ। কুরআনই একমাত্র জীবন বিধান। মানবজাতির সার্বিক কল্যাণ কুরআনের পথ নিদের্শনার মধ্যে নিহিত। কুরআনের এই পথ নির্দেশনা তথা হেদায়াত কেবলমাত্র তারাই অর্জন করতে সক্ষমস যারা মুত্তাকী অর্থাৎ আল্লাহ্কে ভয় করে।

 

আর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে হল রমযানের সিয়াম অর্থাৎ রোযা। তা হলে একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রমযানের রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল একজন আল্লাহর বান্দাহ রোযার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে নিজেকে আল্লাহর বিধান কুরআনের অনুসারী হওয়ার যোগ্য করে গড়ে তুলবে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি করে দিন। আমীন!