০৯ মে ২০২৫, শুক্রবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিজেদের মধ্যে কথা বলে গাছেরা, পাঠায় বিপদের সংকেতও, আবিষ্কার জাপানের গবেষণায়

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ৩০ জানুয়ারী ২০২৪, মঙ্গলবার
  • / 36

বিশেষ প্রতিবেদন: গাছেদের প্রাণ আছে, এই আবিষ্কার করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। এবার গবেষণায় উঠে এল আরও আশ্চর্য তথ্য। ‘গাছেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে’ জানালেন জাপানের একদল গবেষক। জাপানের সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছেন গাছেরা নিজেদের মধ্য কথা বলে। গবেষক দলের অন্যতম সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পিএইচডি শিক্ষার্থী ইউরি আরতানি এবং পোস্টডক্টরাল গবেষক তাকুয়া উয়েমুরা। এই প্রতিবেদন নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশ পেয়েছে। গবেষক জানাচ্ছেন কখন, কোথায় ও কীভাবে গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত উদ্ভিদের কাছ থেকে বায়ুবাহিত ‘সতর্কবার্তা’ পায় এবং তাতে সাড়া দেয়, তার জটিল প্রক্রিয়া উন্মোচন করেছে এই গবেষণা। গবেষণা যত এগিয়েছে, ততই আশ্চর্য হয়ে গেছেন বিজ্ঞানীরা। গাছেরা কীটপতঙ্গের হাত থেকে বাঁচতে সংকেত প্রেরণ করে পাশে থাকা উদ্ভিদদের সতর্ক করে, তেমনি বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। অনেকটা মানবদেহের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে।

‘সায়েন্স অ্যালার্ট’ জানিয়েছে, বাতাসে ভাসমান যৌগগুলি উদ্ভিদকে সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো ঘিরে থাকে। এই যৌগগুলিই যোগাযোগ রক্ষার কাজে সাহায্য করে। এই যৌগগুলি গন্ধের মতো এবং কাছে থাকা গাছপালাকে তারা সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। উদ্ভিদ জগৎ কীভাবে এই ‘এরিয়াল অ্যালার্ম’ গ্রহণ করে এবং তাতে প্রতিক্রিয়া জানায়, সেই সংক্রান্ত ভিডিওটি প্রকাশ করেছেন জাপানী বিজ্ঞানীরা। গাছের যোগাযোগ বিষয়ে ১৯৮৩ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণাটি করা হয়েছে।

 

 

সঠিক সময়ে আসন্ন হুমকির বিষয়ে সতর্ক করতে গাছপালার এই যোগাযোগের নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদ জগতের মধ্যে জটিল ও সূক্ষ্ম মিথস্ক্রিয়াগুলোর ওপর আলোকপাত করে এই গবেষণা। যেখানে পরিবেশগত সম্পর্ক ও উদ্ভিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। গবেষকেরা বলেন, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া বা তৃণভোজী কোনও প্রাণীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশী উদ্ভিদ যখন ভিওসি নিঃসরণ করে, তখন অন্য গাছগুলো সেটি গ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই ধরনের যোগাযোগ বিভিন্ন হুমকি থেকে গাছপালাকে রক্ষা করে। এই গবেষণা পরিচালনার জন্য বায়ুপাম্পযুক্ত একটি পাত্রে বেশ কিছু গাছের পাতা এবং শুঁয়োপোকা রাখা হয়। অন্য পাত্রে অন্য চেম্বারে রাখা হয় অ্যারাবিডোপসিস থালিয়ানা (সরিষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত) নামের একটি সাধারণ আগাছা। জিনগতভাবে অ্যারাবিডোপসিস গাছগুলো ক্যালসিয়াম আয়ন পেলে সবুজ রঙের প্রতিপ্রভা (ফ্লুরোসেন্স) বিকিরণ করে। এটি স্ট্রেস বা কষ্টের অনুভূতির বার্তাপ্রেরক হিসেবে কাজ করে। রাসায়নিক সংকেত, আলোভিত্তিক বার্তা, বৈদ্যুতিক স্পন্দন ও নেটওয়ার্কভিত্তিক জটিল ভাষার মাধ্যমে গাছেরা নিজেদের জগতে যোগাযোগ করে। এ ধরনের যোগাযোগ গাছের বেঁচে থাকা ও মিথস্ক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গাছের রাসায়নিক ভাষা

গাছ বিপদে পড়লে ভোলাটাইল অরগানিক কম্পাউন্ড (ভিওসি) বাতাসে নিঃসরণ করে। ভিওসি প্রতিবেশী গাছে বার্তা পৌঁছায়। এটি খরা বা পোকার আক্রমণের মতো পরিবেশগত বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাঠায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন একটি উদ্ভিদ কোনও তৃণভোজীর (পোকামাকড় বা প্রাণী) আক্রমণের শিকার হয়, তখন এটি নির্দিষ্ট ভিওসি নির্গত করে, যা কাছাকাছি গাছপালাগুলো শনাক্ত করে। এই প্রতিবেশী গাছগুলো তখন অনুরূপ আক্রমণের শঙ্কায় তাদের নিজস্ব রাসায়নিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে।
শিকড়ের জাল

মাটির নিচে শিকড় ও সংশ্লিষ্ট ছত্রাক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। একে ‘উড ওয়াইড ওয়েব’ বা শিকড়ের জাল বলা হয়। এই নেটওয়ার্ক প্রাথমিকভাবে মাইকোরাইজাল ছত্রাকের মাধ্যমে তৈরি হয়। এটি বিভিন্ন গাছের শিকড়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। এই সংযোগের মাধ্যমে গাছেরা নিজেদের মধ্যে পুষ্টি, জল ও তথ্য আদানপ্রদান করে।

সতর্কসংকেত
গাছের যোগাযোগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হল সতর্কসংকেত পাঠানো। আক্রান্ত গাছ যখন ভিওসি নিঃসরণ করে যন্ত্রণার বার্তা পাঠায়, তখন প্রতিবেশী উদ্ভিদগুলো সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হয়। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রাকৃতিক শিকারিদের (যেমন মাকড়সা) আকর্ষণ করে। অর্থাৎ শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গাছেরা তাদের মিত্রদের সাহায্য চাইতে পারে।

বৈদ্যুতিক সংকেত
গাছেরা বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। এই প্রক্রিয়া প্রাণীদের মস্তিষ্কে স্নায়ুতন্ত্রের মতো কাজ করে। কোনও গাছ আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটি তার কাঠামোজুড়ে বৈদ্যুতিক স্পন্দন প্রবাহ করে। এটি গাছের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

নিজেদের মধ্যে কথা বলে গাছেরা, পাঠায় বিপদের সংকেতও, আবিষ্কার জাপানের গবেষণায়

আপডেট : ৩০ জানুয়ারী ২০২৪, মঙ্গলবার

বিশেষ প্রতিবেদন: গাছেদের প্রাণ আছে, এই আবিষ্কার করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। এবার গবেষণায় উঠে এল আরও আশ্চর্য তথ্য। ‘গাছেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে’ জানালেন জাপানের একদল গবেষক। জাপানের সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছেন গাছেরা নিজেদের মধ্য কথা বলে। গবেষক দলের অন্যতম সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পিএইচডি শিক্ষার্থী ইউরি আরতানি এবং পোস্টডক্টরাল গবেষক তাকুয়া উয়েমুরা। এই প্রতিবেদন নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশ পেয়েছে। গবেষক জানাচ্ছেন কখন, কোথায় ও কীভাবে গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত উদ্ভিদের কাছ থেকে বায়ুবাহিত ‘সতর্কবার্তা’ পায় এবং তাতে সাড়া দেয়, তার জটিল প্রক্রিয়া উন্মোচন করেছে এই গবেষণা। গবেষণা যত এগিয়েছে, ততই আশ্চর্য হয়ে গেছেন বিজ্ঞানীরা। গাছেরা কীটপতঙ্গের হাত থেকে বাঁচতে সংকেত প্রেরণ করে পাশে থাকা উদ্ভিদদের সতর্ক করে, তেমনি বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। অনেকটা মানবদেহের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে।

‘সায়েন্স অ্যালার্ট’ জানিয়েছে, বাতাসে ভাসমান যৌগগুলি উদ্ভিদকে সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো ঘিরে থাকে। এই যৌগগুলিই যোগাযোগ রক্ষার কাজে সাহায্য করে। এই যৌগগুলি গন্ধের মতো এবং কাছে থাকা গাছপালাকে তারা সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। উদ্ভিদ জগৎ কীভাবে এই ‘এরিয়াল অ্যালার্ম’ গ্রহণ করে এবং তাতে প্রতিক্রিয়া জানায়, সেই সংক্রান্ত ভিডিওটি প্রকাশ করেছেন জাপানী বিজ্ঞানীরা। গাছের যোগাযোগ বিষয়ে ১৯৮৩ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণাটি করা হয়েছে।

 

 

সঠিক সময়ে আসন্ন হুমকির বিষয়ে সতর্ক করতে গাছপালার এই যোগাযোগের নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদ জগতের মধ্যে জটিল ও সূক্ষ্ম মিথস্ক্রিয়াগুলোর ওপর আলোকপাত করে এই গবেষণা। যেখানে পরিবেশগত সম্পর্ক ও উদ্ভিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। গবেষকেরা বলেন, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া বা তৃণভোজী কোনও প্রাণীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবেশী উদ্ভিদ যখন ভিওসি নিঃসরণ করে, তখন অন্য গাছগুলো সেটি গ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই ধরনের যোগাযোগ বিভিন্ন হুমকি থেকে গাছপালাকে রক্ষা করে। এই গবেষণা পরিচালনার জন্য বায়ুপাম্পযুক্ত একটি পাত্রে বেশ কিছু গাছের পাতা এবং শুঁয়োপোকা রাখা হয়। অন্য পাত্রে অন্য চেম্বারে রাখা হয় অ্যারাবিডোপসিস থালিয়ানা (সরিষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত) নামের একটি সাধারণ আগাছা। জিনগতভাবে অ্যারাবিডোপসিস গাছগুলো ক্যালসিয়াম আয়ন পেলে সবুজ রঙের প্রতিপ্রভা (ফ্লুরোসেন্স) বিকিরণ করে। এটি স্ট্রেস বা কষ্টের অনুভূতির বার্তাপ্রেরক হিসেবে কাজ করে। রাসায়নিক সংকেত, আলোভিত্তিক বার্তা, বৈদ্যুতিক স্পন্দন ও নেটওয়ার্কভিত্তিক জটিল ভাষার মাধ্যমে গাছেরা নিজেদের জগতে যোগাযোগ করে। এ ধরনের যোগাযোগ গাছের বেঁচে থাকা ও মিথস্ক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গাছের রাসায়নিক ভাষা

গাছ বিপদে পড়লে ভোলাটাইল অরগানিক কম্পাউন্ড (ভিওসি) বাতাসে নিঃসরণ করে। ভিওসি প্রতিবেশী গাছে বার্তা পৌঁছায়। এটি খরা বা পোকার আক্রমণের মতো পরিবেশগত বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাঠায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন একটি উদ্ভিদ কোনও তৃণভোজীর (পোকামাকড় বা প্রাণী) আক্রমণের শিকার হয়, তখন এটি নির্দিষ্ট ভিওসি নির্গত করে, যা কাছাকাছি গাছপালাগুলো শনাক্ত করে। এই প্রতিবেশী গাছগুলো তখন অনুরূপ আক্রমণের শঙ্কায় তাদের নিজস্ব রাসায়নিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে।
শিকড়ের জাল

মাটির নিচে শিকড় ও সংশ্লিষ্ট ছত্রাক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। একে ‘উড ওয়াইড ওয়েব’ বা শিকড়ের জাল বলা হয়। এই নেটওয়ার্ক প্রাথমিকভাবে মাইকোরাইজাল ছত্রাকের মাধ্যমে তৈরি হয়। এটি বিভিন্ন গাছের শিকড়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। এই সংযোগের মাধ্যমে গাছেরা নিজেদের মধ্যে পুষ্টি, জল ও তথ্য আদানপ্রদান করে।

সতর্কসংকেত
গাছের যোগাযোগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হল সতর্কসংকেত পাঠানো। আক্রান্ত গাছ যখন ভিওসি নিঃসরণ করে যন্ত্রণার বার্তা পাঠায়, তখন প্রতিবেশী উদ্ভিদগুলো সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হয়। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রাকৃতিক শিকারিদের (যেমন মাকড়সা) আকর্ষণ করে। অর্থাৎ শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গাছেরা তাদের মিত্রদের সাহায্য চাইতে পারে।

বৈদ্যুতিক সংকেত
গাছেরা বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। এই প্রক্রিয়া প্রাণীদের মস্তিষ্কে স্নায়ুতন্ত্রের মতো কাজ করে। কোনও গাছ আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটি তার কাঠামোজুড়ে বৈদ্যুতিক স্পন্দন প্রবাহ করে। এটি গাছের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারে।