নয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিলে কী আছে? বিরোধিতারই বা কারণ কী?

- আপডেট : ২ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার
- / 289
পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: বুধবার তীব্র বিতর্কের মধ্যেই লোকসভায় পেশ হল ওয়াকফ সংশোধনী বিল। বৃহস্পতিবার পেশ হওয়ার কথা রাজ্যসভায়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখে বিলটি সংসদে পাশ করিয়ে নিতে সমস্যা হবে না মোদি সরকারের। তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে এই বিল নিয়ে এত বিতর্ক কেন? বিরোধীদের এই বিল নিয়ে সরব হওয়ার পিছনে কারণ কী?
ওয়াকফ কী?
‘ওয়াকফ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ স্থগিত করা, আবদ্ধ করা, স্থির রাখা, নিবৃত্ত রাখা। ওয়াকফ ইসলামি শরিয়তের একটি বিশেষ পরিভাষা। কোনও সম্পত্তির মালিক নিজের মালিকানা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সম্পত্তি ঘোষণা করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে জনকল্যাণ বা জনসেবার জন্য উৎসর্গ করলে সেই উৎসর্গ করার কাজটিকে ‘ওয়াকফ’ বলা হয়।১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মুসলমান ওয়াকফ বৈধকরণ আইনে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ওয়াকফ অর্থ কোনও মুসলমান কর্তৃক তার সম্পত্তির কোনও অংশ এমন কাজের জন্য স্থায়ীভাবে দান করা, যা মুসলিম আইনে ‘ধর্মীয়, পবিত্র বা সেবামূলক’ হিসেবে স্বীকৃত।এক কথায়, ওয়াকফ সম্পত্তি হল সেই সমস্ত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি, যা দলিলের মাধ্যমে আল্লাহর নামে করে দেওয়া হয়। নথিপত্রের যুগ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে।সাধারণত কোনও জনকল্যাণ মূলক কাজে ব্যবহৃত হয় এই জমি। অথবা কেউ উত্তরসূরী হিসেবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। এই সম্পত্তি কখনও হস্তান্তর করা যায় না। সাধারণত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবর, মসজিদের জন্য, গরিব মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য জমি ব্যবহার করা হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা দান করা হয় এবং বোর্ডের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিটি রাজ্যের একটি ওয়াকফ বোর্ড আছে।
আরও পড়ুন: লোকসভায় ওয়াকফ বিল পেশের পর মুজাফফরনগর সহ ইউপি ও দিল্লিতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে
ওয়াকফ বোর্ড কী?
সুলতানি আমলে ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য আলাদা বোর্ড বা কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই ওয়াকফ বোর্ড তৈরি হয়ে যায়। এই বোর্ডের মূল কাজ ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন পাশ হয়। ১৯৯৫ সালে কংগ্রেস আমলে ওয়াকফ আইন সংশোধন করে ওয়াকফ বোর্ডকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালেও ওয়াকফ আইন সংশোধন করা হয়েছিল। সেই সময়ও কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস সরকার।
নয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিলে কী কী পরিবর্তন আনা হয়েছে?
ওয়াকফ বিলের ৪০ নম্বর ধারা আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ডের দখল করা সম্পত্তি বা জমিতে সরকার কোনও রকম হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কোনও রকম পর্যালোচনা ছাড়াই ওয়াকফ বোর্ড জমি দখল করতে পারে। কোনও সম্পত্তি নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ওয়াকফ বোর্ডের আইনি বিবাদ চললেও তাতেও হস্তক্ষেপ করতে পারে না সরকার। সরকার সংশোধিত ওয়াকফ আইনে মূলত ওয়াকফ অধিকার খর্ব করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিতর্কিত কোনও সম্পত্তির মালিকানা আদতে কার, তাও খতিয়ে দেখার আইনি এক্তিয়ার সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে বলে সরব বিরোধীরা। নতুন সংশোধনী বিলে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার সরকার কেড়ে নিতে চাইছে বলে অনেকেই মনে করছেন। কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কিনা, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনও আধিকারিককে। নতুন বিলে ওয়াকফ বোর্ডে দুই অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পুরনো আইনে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করলে, তা চিরদিনের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবেই থেকে যেত। নতুন বিলে এবার থেকে সেটাকেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে। ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ইসলামিক ধর্মস্থান বা অন্য কোনও ইসলামিক প্রার্থনাস্থল তৈরি হলেও এবার থেকে সেটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করা যেতে পারে।
ওয়াকফ সংশোধন কেন করা হচ্ছে?
সরকারের যুক্তি, বর্তমান আইন অনুযায়ী, ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তি কোনও ভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকে না। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারে ওয়াকফ বোর্ড। গেরুয়া শিবিরের দাবি, ওয়াকফ সম্পত্তির সমস্ত সুবিধা ভোগ করছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী। বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মুসলিমরা। নতুন আইনে সাধারণ মুসলিমরা উপকৃত হবেন। সাচার কমিটির রিপোর্টেও ওয়াকফ নিয়মের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছিল।
‘ইন্ডিয়া’-র বিরোধিতার কারণ কী?
সংখ্যালঘুদের একাংশের ধারণা, এই বিল পাশ হয়ে গেলে ইসলামিক সম্পত্তি সরকার হস্তগত করবে। এই বিল ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বত্ত্বায় আঘাত করবে বলে মনে করছেন বিরোধীরা। ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের প্রবেশ নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে বিরোধী শিবিরের। একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে টার্গেট করার জন্য এই বিল সংশোধন করা হচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
ওয়াকফ কত প্রকার?
ওয়াকফ মূলত তিন প্রকার
১) ওয়াকফ ফি লিল্লাহ,
২) ওয়াকফ আলাল আওলাদ (অর্থাৎ ব্যক্তিগত ওয়াকফ)
৩) মিশ্র ওয়াকফ।
– কেবল ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে সৃষ্ট ওয়াকফকে বলা হয় ওয়াকফ ফি লিল্লাহ।
– উৎসর্গকারীর নিজের কিংবা পরিবার বা বংশধরদের ভরণপোষণ বা উপকারার্থে ওয়াকফ করা হলে তাকে বলা হয় ওয়াকফ আলাল আওলাদ।
– আর মিশ্র ওয়াকফে ধর্মীয় ও দাতব্য প্রকৃতির সর্বজনীন উদ্দেশ্য এবং উৎসর্গকারীর পরিবার বা বংশধরদের উপকার দুটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দেশে ওয়াকফ বোর্ড কতটুকু জমি নিয়ন্ত্রণ করে?
ওয়াকফ বোর্ড দেশ জুড়ে ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তির ৯.৪ লক্ষ একর জমি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। যার আনুমানিক মূল্য ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। এর ফলে ওয়াকফ বোর্ড ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম জমির মালিক। ভারতীয় রেল এবং সশস্ত্র বাহিনীর পরে এর অবস্থান।দেশজুড়ে মোট ৩০টি ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে। সাধারণত কৃষিজমি, ভবন, দরগা/মাজার, কবরস্থান, ঈদগ্বাহ, খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ, প্লট, পুকুর, স্কুল, দোকান এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ সম্পত্তি হতে পারে।ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ওয়াকফের উদাহরণ হচ্ছে মসজিদে কুবা। ৬২২ সালে মদিনা মনোয়ারায় নির্মিত হয়। তারও ছয় মাস পর ইসলামি ওয়াকফের দ্বিতীয় উদাহরণ মদিনার কেন্দ্রে মসজিদে নবী। রাসূল (সা.)-এর সময় থেকে শুরু করে খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে অনেক ওয়াকফ কার্যক্রম চালু হয়।